Sunday, July 15, 2018

মাদকবিরোধী অভিযানে পক্ষপাতের অভিযোগ

বাংলাদেশে চলমান মাদকবিরোধী যুদ্ধের পক্ষপাতমূলক আচরণের সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছে উর্দুভাষী বাংলাদেশি বা বিহারি জনগোষ্ঠি।
বিশেষ করে মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে র্যাবের গত ২৬ মে পরিচালিত অভিযানে অনেক হয়রানি ও অন্যায় আচরণের অভিযোগ উঠেছে। ক্যাম্পের সব প্রবেশ পথ বন্ধ করে দিয়ে ডগ স্কোয়াড নামিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা এই অভিযান চালানো হয়। প্রাথমিকভাবে ৫০০জনকে আটক করা হয়। ৩০০জনকে ছেড়ে দেয়া হয়। যাচাই-বাছাই করে ১৫৩জনকে রেখে বাকিদেরও ছেড়ে দেয়া হয়।
মাদকবিক্রেতাদের সাথে সাথে অনেক নিরীহ মানুষও গ্রেপ্তার হয়েছেন ও সাজা ভোগকরছেন। জেনেভা ক্যাম্পে এরকম কয়েকজনের কাছের মানুষের সাথে কথা বলে বেরিয়ে এল এই সত্যগুলো।
সেই অভিযানের পর থেকে ক্যাম্পের প্রাণবন্ত পরিবেশ একদম উধাও। অপরিচিত কাউকে দেখলে এড়িয়ে চলছেন সবাই ।
প্রথমেই কথা হল আটকে পড়া পাকিস্তানিদের সংগঠন এসপিজিআরসি'র এক নেতার সাথে। তিনি একেবারে উড়িয়ে দিলেন না ক্যাম্পে মাদক বিক্রির অভিযোগ। বললেন," অভাবে স্বভাব নষ্ট। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের প্রতি বৈষম্য বেড়েছে। অনেক আগে থেকেই আমরা চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যে বৈষম্য ও অবহেলার শিকার। হাইকোর্টের এক রায়ের কারণে আমরা ইদানিং ভোট দিতে পারি বটে। কিন্তু  আমরা পাসপোর্ট করতে পারি না, বাসা ভাড়া নিতে পারি না, ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারি না আমাদের মায়ের পরিচয়ে।"
"আগে রমজানে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে সরকারের মাধ্যমে আমাদের জন্য সাহায্য আসত, আমরা তা পেতাম। এখনও আসে, কিন্তু বিগত কয়েক বছর যাবত আমাদের কাছে তা পৌছাচ্ছে না। "
বিভিন্ন চ্যানেলে ক্যাম্পে মাদক সেবনের খবরের ব্যপারে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি জানান," কেউ কেউ এখানে মাদক বিক্রি করে, তবে কোন মাদক সম্রাট এখানে নেই। আর প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ এই ক্যাম্পে আসে। কেউ আসে বিরিয়ানি খেতে , কেউ অন্য মতলবে। সবাইকে কি নজরে রাখা সম্ভব।"
অন্য এক নেতা জানালেন," সারাদেশে এই সমস্যা ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু এই ক্যাম্পের সমস্যা  না। এন্ট্রি পয়েন্টে এগুলো আটকালে তো এটি এতো বাড়তে পারতো না। "
"মাদক ব্যবসায়ীরা এই ক্যাম্পের কেউ না, তারা বাইরে থাকে।তাদের হাতেই এ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ।"
ক্যাম্প ঘুরে বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা গেল তাদের ঘনিষ্ঠ জনেরা অবিচারের শিকার।
একজন জানালেন যারা ক্যাম্পে সত্যিকার অর্থে মাদক বিক্রি করতেন তারা আগের দিন সন্ধ্যায় ঐ অভিযানের খবর পেয়ে গা ঢাকা দেন। আর নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিলেন ,"আগামীকাল এই ক্যাম্পে রেড হবে।"
যারা র্যাবের অভিযানে ধরা পড়েছেন তাদের মধ্যে ৩০/৪০জন মাদক বিক্রেতা আর বাকিরা নির্দোষ বলে দাবি করলেন ক্যাম্পবাসি।
হামিদা'র দুই ছেলেকেই ধরে নিয়ে গেছে র্যাব। অনেক কষ্ট নিয়ে বললেন যখন ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন কর্মজীবি দু'ছেলেই ঘুমে। সাঈদ ,৩০,কারচুপি'র কাজ করত আর ইউসুফ,২৫, পেশায় একজন কসাই। দুই ছেলে যে নির্দোষ সেটি বোঝাতে তাদের ঘরে নিয়ে গেলেন সাঈদ-ইউসুফের বৃদ্ধ বাবা। ঘরের একপাশে দেয়ালে হেলানো রয়েছে সাঈদের কারচুপির কাজের টেবিল। বাইরে সিঁড়ির উপর পড়ে আছে ইউসুফের মাংস কাাটবার কাঠের টুকরো আর জংধরা বাটখারা। বেচারা অনেক অনুনয় করলেন যেন বুঝিয়ে লিখি তার ছেলেরা নির্দোষ , তাদের যেন ছেড়ে দেয়া হয়। ছেলেদের অবর্তমানে পরিবারটি বেশ সমস্যায় পড়েছে।
প্রতিবন্ধি মেয়ে সাহানা'র,২৮, দোষ সে র্যাবকে দেখে ভয়ে দৌড় দিয়েছিল। অন্য সবার সাথে তাকেও র্যাবের গাড়িতে তোলা হয়। এখন সে আছে কাশিমপুর কারাগারে। তার চাচা মো: সোবহান জানালেন তার ভাতিজিকে যেন দ্রুত ছেড়ে দেয়া হয়।
৭০ বছরের মোহম্মদ ভুলু একজন মুদি দোকানি। তার হৃদরোগ রয়েছে। তাকে আটক করে ৬ মাসের কেস দিয়ে দেয়া হয়েছে।
ইলেক্ট্রেশিয়ান তাজউদ্দিন, ৩৫, কে আটক করে ৬ মাসের সাজা দেয়া হয়েছে। তার স্ত্রী জানালেন তাকে যখন ধরে নিয়ে যাওয়া হয় তখন বলা হয়েছিল কথা বলে ছেড়ে দিব। আর এখন মামলার কাগজও হাতে পাচ্ছেন না যে আদালত থেকে জামিন নিবেন।
পেশায় রঙমিস্ত্রি মো: আলম,৫৫,  কে ধরে নিয়ে  ২৪৫ পিস ইয়াবা পাওয়া গেছে এমন মামলায়  ফাঁসিয়ে  দেয়ার অভিযোগ করেছে স্বজনেরা।
আর ক্যাম্পে যারা মাদক ব্যবসা করতেন এমন কারো কারো স্বজনেরা অবিচারের অভিযোগ তুলেছেন। যেমন নাদিম ওরফে পঁচিশ ,যিনি গত ১১ জুলাই নারায়ণগঞ্জে এক 'বন্দুকযুদ্ধে' নিহত হন , দু'বছর আগেই এ ব্যবসা ছেড়ে দেন বলে দাবি করেছেন তার স্বজনেরা। মোহম্মদপুর থানায় গিয়ে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে এ ঘোষণা দেন বলে দাবি করেন নাদিমের বোন। আট মাস আগে একটি সংস্থার লোকজন তাকে আটক করে । সেসময় প্রায় একমাস তিনি জেল খাটেন। এরপর গত ১৪ জুন এক দল সাদা পোশাকধারী ব্যক্তি তাকে মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেট ক্যাম্প থেকে তাকে তুলে নিয়ে যায়। তার কোন হদিস নিকটজনেরা এতদিন পাননি। সর্বশেষ 'বন্দুকযুদ্ধে' তিনি মারা যাবার পর তার খোঁজ পান স্বজনেরা।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত বেশ কিছু তথ্যের সাথেও ভিন্নমত প্রকাশ করেন নাদিমের স্বজন ও পড়শিরা। যেমন তারা দাবি করেন তিনি মাদক বিক্রি করতেন এবং 'মাদকসম্রাট' ছিলেন না। ঢাকায় তার কোন জমি বা ফ্ল্যাট ছিল না।
অবশ্য এই দাবিগুলো সেভাবে যাচাই করে করে দেখবার সুযোগ হয়নি সময়, প্রয়োজনীয় যোগাযোগ ও অর্থের অভাবে।
এর বাইরে ক্যাম্পের অন্যান্য পেশাজীবি মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেল প্রকৃত মাদক  বিক্রেতারা খুব কমই ধরা পড়েছেন এই অভিযানে। আর হয়রানি'র শিকার হচ্ছেন নিরীহ মানুষেরা।
সংবাদপত্র আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ঘেঁটে বিগত বেশ কয়েকছরে বিহারি সম্প্রদায়ের উপর দলগত বিদ্বেষের কিছু ঘটনার কথা জানা গেল। ২০১৪ সালের জুন মাসে মিরপুরের কুর্মিটোলা ক্যাম্পে আক্রমণ চালায় একদল বস্তিবাসী। সেসময় আগুনে পুড়ে মারা যায় একই পরিবারের ১০জন বিহারি।
মিরপুর ১১ নম্বর সেকশনে রোড-৪ ব্লক-সি'তে বসবাসরত কিছু বিহারি সম্প্রদায়ের লোককে রাস্তা বড় করার নামে উচ্ছেদের চেষ্টা চালানো হয়। যথাযথ পুনর্বাসনের চেষ্টা না করে তাদের উচ্ছেদের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করে বিহারিরা।
সর্বশেষ বাংলাদেশের ১৩টি জেলার ৭০টি বিহারি ক্যাম্পে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করবার একটি উদ্যোগ নেয়া হয়। গত ৯ মার্চ উচ্চ আদালতে গিয়ে এটি কার্যকর করবার উপর একটি স্থগিতাদেশ নিয়ে আসেন বিহারি সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ।
চলমান মাদকবিরোধী অভিযানে এই দল-বিদ্বেষ আরো প্রকটভাবে ধরা পড়েছে। যারা নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত,  নানা  অবহেলার শিকার তাদের পক্ষে কিভাবে ক্যাম্পে মাদক ব্যবসা চালিয়ে নেয়া সম্ভব। বাইরের প্রভাবশালী কারও সম্পৃক্ততা এখানে রয়েছ। অথচও তারা রয়ে যাচ্ছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে,জেলে পচছে নিরীহ মানুষ। এই হতাশার কথা ফুটে উঠল একজনের কথায়," আপনি আমাকে নফরত(ঘৃণা) করেন,  দূরে ঠেলে রাখেন,আর আমি আপনার এলাকায় বসে আপনার ছেলেমেয়েকে নষ্ট করবার কারবার চালিয়ে যাব দিনের পর দিন এমন হিম্মত আমার নাই। দু'একজন যে নাই তা না। কিন্তু তারা খুচরা বিক্রেতা । বড় পাইকার ও ব্যবসায়ীরা তো থাকে ক্যাম্পের বাইরে। তাদের কন্ট্রোলেই সবকিছু। তারা তো বিহারি না। তাদের ধরা হচ্ছে না কেন?"

No comments:

Post a Comment