Monday, July 22, 2019

জাতিসংঘের প্রতিবেদন এবং বাংলাদেশে মেথের বাজার


জাতিসংঘের সর্বশেষ সংঘবদ্ধ অপরাধী সংগঠনের উপর করা এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বাংলাদেশে মাদক ব্যবসার সম্ভাব্য আকারের চিত্র। গবেষণা প্রতিবেদনটির শিরোনাম “Transnational Organized Crime In Southeast Asia : Evolution, Growth and Impact” আর এটি তৈরি করেছে United Nations Office on Drugs and Crime

এই পোস্টে ”মেথ ” বলতে বোঝানো হয়েছে সব ধরণের মেথাম্ফেটামিন ও ইয়াবাকে ।
জাতিসংঘের মতে বাংলাদেশে ইয়াবার মোট বাজার ৫.৫ বিলিয়ন ডলার। এ হিসেব বের করা হয়েছে মোট মাদকসেবীর সংখ্যা ও একজন মাদকসেবী গড়ে বছরে কি পরিমাণ মাদক গ্রহণ করে থাকেন তার উপর ভিত্তি করে।


সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যপার হল পূর্ব এশিয়ার ১২টি দেশ মেথাম্ফেটামিনকে তাদের প্রধানতম মাদক হিসেবে চিহ্নিত করেছে । মূলত চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, মালেয়িশয়া, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মত ধনী দেশগুলো এর প্রধানবাজার। মেথাম্ফেটামিনের দু'টি রুপ--- ক্রিস্টাল মেথ ও ইয়াবা ব্যপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এই অঞ্চলে। চীনে মেথাম্ফেটামিনের  কারখানা ধ্বংস করবার ফলে মেথাম্ফেটামিনের  কারখানাগুলো ব্যপকভাবে গড়ে উঠেছে মিয়ানমারের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে।  

এর বাইরে বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে এই প্রতিবেদনে:
১.    পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে গত পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মেথ (সব জাতের) ধরা পরেছে ২০১৮ সালে এবং এর পরিমাণ ১২০ মেট্রিক টন ।
২.    সংঘবদ্ধ অপরাধী গোষ্ঠি মাদকের অর্থ পাচার বা শাদা করার জন্য ক্যাসিনোগুলোকে ব্যবহার করছে । চীনে এ ধরণের ক্যাসিনো বন্ধ করে দেয়ার ফলে কম্বোডিয়া, মায়ানমার ও ফিলিপিন্স এ নতুন করে কিছু  ক্যাসিনো গড়ে উঠেছে ।
৩.    বাংলাদেশ, ভারত, চীন, ভিয়েতনাম, লাওস এবং থাইল্যান্ড থেকে মিয়ানমারের দিকে মেথ তৈরির উপকরণ ও ল্যাবের সরঞ্জাম যাচ্ছে। সংঘবদ্ধ অপরাধী দল আনেকসময় বৈধ পণ্যের আড়ালে এই পাচার কাজ করছে।
৪.    কুরিয়ার সার্ভিস, ই-কমার্সের ব্যপক ব্যবহার করছে মাদক পাচারকারীরা । নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, কোরিয়া ও সিঙ্গাপুরে ক্রিস্টাল মেথ পাচারে এ মাধ্যমগুলো বেশ জনপ্রিয় হয়ে  উঠেছে পাচারকারীধের মাঝে ।  এছাড়া চায়ের মোড়কে ক্রিস্টাল মেথ পাচার করা হচ্ছে ধনী দেশগুলোতে ।
৫.    মিয়ানমারে অপিয়াম  উৎপাদনের  জমি দিন দিন কমছে । শান প্রদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে চাষ হয় পপির । আর হয় কাচিন স্টেটে । তবে জমির পরিমাণ কমলেও পপির চাষ মোটামুটি একইরকম আছে কাচিন স্টেটে । ২০১৮ সালে কাচিন স্টেটে মোট অপিয়াম  উৎপাদনের জমির পরিমাণ হচ্ছে ৯ শতাংশ । উল্লেখ্য কাচিন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাথে রাখাইনের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের যোগ রয়েছে । তবে সম্প্রতি মেথ তৈরির কারখানা উত্তর রাখাইনে ব্যপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে।

আগেই বলা হয়েছে জাতিসংঘের মতে বাংলাদেশে মেথের বাজার ৫.৫ বিলিয়ন ডলার । চীনে ১০.৩ বিলিয়ন ডলার আর অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে এর বাজার ১১.১ বিলিয়ন ডলার । বাংলাদেশের মত ছোট একটি দেশে মেথের বাজার চীনের বাজার এবং অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড-এর বাজারের প্রায় অর্ধেক । জিডিপি,রপ্তানি আর আমদানির সাথে তুলনা করলে এর ব্যপকতা সম্পর্কে একটু ধারণা পাওয়া যাবে । আমার হিসেবে বাংলাদেশের  মেথের বাজার জিডিপি’র ১.৭৫  শতাংশ, রপ্তানি’র  ১৩.৪১ শতাংশ এবং আমদানির  ১১.৯৫ শতাংশ । অথচ চীনে এই বাজার জিডিপি’র ০.০৭২ শতাংশ , অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড-এর মোট  জিডিপি’র ০.৬৫ শতাংশ , আশিয়ান দেশগুলোর জিডিপি’র ০.৮৫ শতাংশ আর পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর (জাপান+ দ. কোরিয়া) জিডিপি’র ০.১৩ শতাংশ ।

                                                     (Data Source : UNODC, Wikipedia, ASEAN)

প্রতিবেদন পড়বার পর আমার নিজস্ব কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরছি:

১. প্রতিবেদনটিতে বার বার উঠে এসেছে এইঅঞ্চলের অনিয়ন্ত্রিত ক্যাসিনোগুলোর কথা। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির টাকা ফিলিপিন্সের যে ক্যাসিনোতে চলে গিয়েছিল সেখানেও প্রভাব ছিল ম্যাকাও ভিত্তিক জুয়ারি চক্রের। বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো গত কয়েক বছর যাবত মাদক ও সোনার বড় বড়চালানআটককরেছে। এতে এসব অপরাধী গোষ্ঠির যে ক্ষতি হয়েছে হয়ত তারই বদলা নিতে রিজার্ভ হ্যাকিং করা হয়েছে। 


২. মেথ তৈরির উপকরণ কিন্তু আশেপাশের দেশ থেকে ---যার ভেতর বাংলাদেশও রয়েছে--- মিয়ানমারে যাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে এফিড্রিন, সিউডোএফিড্রিন, ফিনাইল প্রপোনেন, ফিনাইল এসিটিক এসিড, ব্রমোপ্রপিওফেনন, থিওনাইলক্লোরাইড। 


এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে বছর তিনেক আগে চট্রগ্রাম  বন্দরে সান ফ্লাওয়ার অয়েলের সাথে মেশানো অবস্থায় লিকুইড কোকেনের একটি চালান কাস্টমস আটক করে । যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দা তথ্যের উপর ভিত্তি করে এই অভিযান চালানো হয়। তবে জাতিসংঘের এই গবেষণা প্রতিবেদনের পর এটি স্পষ্ট যে এ ধরণের চালান অহরহ বাংলাদেশের উপর দিয়ে যাচ্ছে । আর সংঘবদ্ধ অপরাধীদের বেশ শক্ত পদচারণা এদেশে রয়েছে। আর শুধু  উপকরণ নয় অনেক ক্ষেত্রে মাদকের কারিগরদেরও যাতায়াত হচ্ছে উৎস দেশ ও বাজার দেশের মধ্যে । যেমন প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে মালয়েশিয়ায় আটক হওয়া কিছু তাইওয়ানির কথা যারা কাজ করতেন মেথ ল্যাবের কেমিস্ট হিসেবে ।

৩. জাতিসংঘের ঐ গবেষণা প্রতিবেদনে মানব পাচার নিয়েও প্রাপ্ত তথ্য ও ফলাফল তুলে ধরা হয় । জাতিসংঘের মতে দুর্নীতির ব্যপক বিস্তারের ফলে এই অঞ্চলে মানব পাচারের ব্যপকতা বেড়েছে। বাংলাদেশের দিকে তাকালেও এর সত্যতা দেখা যায়। তবে থাইল্যান্ডে মানব পাচারের কারণে একজন লে. জেনারেলের সাজা হলেও বাংলাদেশে এখনও মানব পাচারের অভিযোগে কোন রাঘব-বোয়ালকে জেলে যেতে হয়নি ।

৪. এম্ফাটেমিন জাতীয় মাদকের আরেকটি রুপ হচ্ছে ফেনিথিলিন বা ক্যাপটাগন । মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এর রয়েছে ব্যপক চাহিদা । আর এটি বিকোয় প্রতিটি ৫ ডলার থেকে ২০ ডলারে । এক অনুসন্ধানী সংবাদ প্রতিবেদনে উঠে আসে যে সিরিয়ার বিবদমান গোষ্ঠি ও আইএ্স এর অর্থের অন্যতম উৎস হল এই ক্যাপটাগন । এর আকার ও দাম এধরণের গোষ্ঠির কাছে একে বেশ আকর্ষণীয় কওে তুলেছে । কাজেই এই অঞ্চলে এই মেথ ব্যবসায় যে এধরণের গোষ্ঠি যে নেই সেটি হলফ করে বলা যাবে না । বাংলাদেশ , শ্রীলঙ্কা ও  ফিলিপিন্স এ আইএসের অপতৎপরতা দেখা গেছে । বাংলাদেশ ও ফিলিপিন্স - এ মেথের বাজার রয়েছে । আর শ্রীলঙ্কায় আটক হওয়া দেশটির সবচেয়ে বড় হেরোইনের চালান এসেছিল বাংলাদেশ থেকে ।


জাতিসংঘের এই প্রতিবেদনের পর এটি আরো স্পষ্ট হলো যে বাংলাদেশে মাদক বিস্তার লাভ করছে উদ্বেগজনকভাবে । প্রভাবশালীদের মদদে
কারণেই মাদক ও মানব পাচারকারীদের বাড়বাড়ন্ত। বাংলাদেশ থেকে মেথ তৈরির উপকরণের সীমানা পারি দেয়া আর টাকা পাচারের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় এটি বলা যায় যে বাংলাদেশের বৈধ বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে চলছে বেআইনি ব্যবসা। সম্প্রতি ঢাকার জিগাতলায় ক্রিস্টাল মেথ তৈরির কারখানা  আবিষ্কার হওয়ায় এ সন্দেহ অমূলক নয় যে দেশের ভেতর মেথ ল্যাব গড়ে উঠছে ।খুব দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে বাংলাদেশ হয়ত তার বড় সমস্যা সমাধানে আশিয়ানের মত প্রতিবেশীদেরও পাশে পাবে না ।