Tuesday, June 12, 2018

প্রয়োজন বিদেশি উপদেষ্টার

অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত বাজেটের পর সংসদের ভেতরে ও বাইরে তাকে নিয়ে তীব্র সমালোচনা চলছে। আর্থিক খাত কেলেঙ্কারির পুরো দায় সবাই তাঁর উপরই চাপাতে চায়। সর্বশেষ ব্যাংকগুলোর উপর কর-কমানোর প্রহস্তাবগুলোও অনেকেই ভালো চোখে দেখেনি। এ লেখার উদ্দেশ্য তাঁর ও তাঁর বাজেটের সমালোচনা নয়, বরং ভবিষ্যতে অর্থমন্ত্রী, উপদেষ্টা ও বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে আমরা কি ধরণের লোক দেখতে চাই সেবিষয়ে আমার পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা ।
ভবিষ্যতে যে সরকারই আসুক আমার মনে হয় না বিগত  বছরগুলোতে আর্থিক খাতে যে সুনামি বয়ে গেছে তাতে কোন পেশাদার আর মেরুদন্ডওয়ালা লোকজন এসব পদে বসতে চাইবেন। কেউই চাইবেননা রাজনৈতিক দলগুলো তাঁর ঘাড়ে বন্দুক রেখে  শিকার করুক।
সমাধান হচ্ছে এসব পদের জন্য বিদেশি খোঁজা, বাংলাদেশি দ্বৈত নাগরিক নয়। আইনে কি আছে জানি না, তবে আইন বাঁধা হয়ে দাড়ালে মন্ত্রী ছাড়া অন্য পদগুলোর জন্য পেশাদার বিদেশিদের খুব দরকার। তাঁরা সরকারের লক্ষ্যের ফর্দ নিয়ে কর্মপরিকল্পনা তৈরি করবেন , সেভাবে তাঁদের দল গঠন করবেন আর লক্ষ্য পূরণে কাজ করে যাবেন।
বছরখানেক আগে  আমি বিভিন্ন পেশায় বিদেশিদের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে একটি লেখা লিখেছিলাম। আমাদের দেশে গোত্রীয় রাজনীতির কারণে দেশীয় পেশাজীবিদের ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক সরকারের সময়ে সেভাবে স্বচ্ছন্দ ও তৃপ্তি নিয়ে কাজ করতে পারেন না।
নিজ গোত্রের সরকারের সময় একজন পেশাজীবি তাঁর কর্মক্ষেত্রে যে স্বচ্ছন্দ ও তৃপ্তি(ইউিটিলিটি) পান, ভিন্ন গোত্রের সময়ে সেটি পাননা। অনেক সময় তাকে নানা ধরনের প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়।
একজন বিদেশির সেসব ঝামেলা নেই। তিনি সব গোত্রের সরকারের সময়ে একই স্বচ্ছন্দ ও তৃপ্তি নিয়ে কাজ করেন। ফলে নির্ধারিত লক্ষ্য পূরণে তাঁর কাজ করে যাওয়াটা বেশ সহজ।
এর বাইরে আমাদের দেশের "আমরা-আমরাইতো"  সংস্কৃতি  পেশাজীবিদের উৎকর্ষতা অর্জনের ক্ষেত্রে অন্তরায়। বিদেশিদের নিয়োগ এটি আমূল বদলে দেবে বলে আমার ধারণা।
আর আমাদের দেশে ভিন্ন গোত্রের পেশাজীবিদের অন্ন গোত্রের লোক ও বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে চোখ-রাঙানি , হয়রানি ও ব্ল্যাকমেইলিং এর শিকার হতে হয়। বিদেশিদের নিয়োগের ফলে এর প্রকোপ হয়ত কিছুটা কমবে।
অনেক সময় দেখা যায় গোত্র সরকারগুলোতে এধরনের উঁচু পদের লোকজনের দ্বিমত হবার সুযোগ খুব কম। ফলে তাঁদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনেক অপ্রিয় কাজে সায়, যা অনেক ক্ষেত্রেই অনৈতিক, দিতে হয় অথবা একেবারে সরকারের শেষ সময় পর্যন্ত রয়ে যেতে হয়।
বিদেশিদের আত্মমর্যাদা একটু বেশি হওয়ায় তাঁরা অন্যায় আব্দারের কাছে মাথানত না করে বরং পদত্যাগ করে চলে যাবেন। আর খুব বেশি অসুবিধায় পড়লে সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাস তাঁদের পাশে দাড়াবে। কাজেই আমাদের গোত্রদ্বন্দ্বে-নাকাল দেশে ও দুর্নীতিতে জর্জরিত সমাজে তাঁরা বেশ ভালভাবেই লক্ষ্যপূরণে কাজ করে যেতে পারবেন।
অনেকেই দেশপ্রেমের দোহাই দিবেন। তথাকথিত দেশপ্রেমিক পেশাজীবিদের দৌরাত্ম্য -এ দেশের অর্থনীতির যে বারোটা বেজেছে সেটিতো আর নতুন করে বলতে হবে না। আর দু'টি খাতে বিদেশিদের অবদান কিন্তু স্বীকার করতেই হবে। একটি হল ক্রিকেট , অন্যটি তৈরি পোশাক খাত। অন্যান্য খাতেও তাঁদের অবদান বিস্তৃত করা যায়। আর মধ্যপ্রাচ্যের বহুদেশে  এ ধরণের পদগুলো অলঙ্কৃত করছেন বিদেশিরা।
বাংলাদেশ সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা বা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর  পদ নিতে ক'জন বিদেশি রাজি হবেন সেটিও দেখার বিষয়। তবে বাংলাদেশ তো মোটামুটিভাবে সফল কোন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি'র চেয়ে কম নয়। চাইলেই অনেককে এ ধরণের পদের জন্য অনেককে পাওয়া যাবে।
আমার নিজস্ব অভিমত হচ্ছে বিদেশি কোন সরকারের/প্রাদেশিক সরকারের উপদেষ্টা, বহুজাতিক কোম্পানির সাবেক প্রধান নির্বাহি বা নিরীক্ষা বিভাগের প্রধান, মার্চেন্ট ব্যাংকার, চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট,বিনিয়োগ /কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ এধরণের লোকজন।
ভাল হয় ইউরোপিয়ান/আফ্রিকান যাঁর মধ্যপ্রাচ্য বা আফ্রিকার দেশগুলোতে কাজ করবার অভিজ্ঞতা রয়েছে। পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে চাইলেই এধরণের বহু পেশাজীবি পাওয়া যাবে। এসব দেশের সরকার আর রাজনীতির বিবর্তন অনেকটা উপমহাদেশের মতই। এছাড়া ক্রোনি ক্যাপিটালিজম আর দুর্নীতির সাথে কাজ করবার অভিজ্ঞতাও এঁদের আছে। লম্বা সময়ের জন্য তাঁরা এখানে কাজ করবেন কিনা সেটি একটি প্রশ্ন।
একটা প্রশ্ন উঠতে পারে বিপুল অর্থ ব্যয়ে তাঁদের নিয়োগ নিয়ে। এখানে যেটি বিবেচনায় নিতে হবে সেটি হল পেশাদারিত্ব আর স্বাধীনভাবে কাজ করবার সক্ষমতা।আমাদের দেশের পেশাজীবি গোষ্ঠি, নিরপেক্ষ হলেও, দেশের কদর্য গোষ্ঠিতন্ত্রের কারণে সেটি পারেন না। নানাভাবে তাঁদেরকে ভয় আর হয়রানির মাধ্যমে কোনঠাসা করে রাখা হয়।  সেনানির্ভর একটি গোষ্ঠি প্রচলিত অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন চায় না রাজনীতির উপর তাদের কব্জা বজায় রাখার জন্য। ফলে হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। আর গোষ্ঠিবাজরা দেশপ্রেমের ধুয়ো তুলে ভবিষ্যতের আবাস করছেন বিদেশে।
বিদেশিরা এসব নানা ধরণের প্রভাববলয় থেকে অনেকটাই মুক্ত। ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোন কারণও তাঁদের নেই। তাঁদের সুশাসনের কারণে অবস্থার যে উন্নতি ঘটবে সেটিকে বিবেচনায় নিয়ে তাঁদের নিয়োগকে দেখতে হবে। আর ইউটিলিটি তত্ত্ব প্রয়োগ করে আমরা দেখলাম যে এ ধরণের পদক্ষেপের যথেষ্ট যৌক্তিক ভিত্তি রয়ে গিয়েছে।

No comments:

Post a Comment